আমাদের কুমিল্লা .কম :
23.03.2018
নিগার সুলতানা নুপুর
এক সংগ্রামী জীবনের গল্প♦ দেলোয়ার জাহিদ…..জন্মসূত্রে কুমিল্লার না হলেও জীবনের বেশিরভাগ সময় কুমিল্লার মাটি আর মানুষের সাথে মিশে থাকা একটি নাম। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধেও যাঁর ছিল অসামান্য অবদান।স্বাধীনতার মাসে কুমিল্লার এই সূর্যসন্তানের সম্মানার্থে তাঁর সংগ্রামী জীবনের কিছু কথা—- দেলোয়ার জাহিদের জন্ম নরসিংদী জেলার উত্তর প্রান্তে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরে সররাবাদ নামের ছোট্ট একটি গাঁয়ে। কিন্তু শৈশব, কৈশোর ও তার যৌবনের দূরন্ত দিনগুলি কেটেছে কুমিল্লায়। শিক্ষাজীবন কেটেছে আর দশজন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানেরই মতো, শুরু যার এক মাটির ঘরের বিদ্যাপীঠে। কুমিল্লা ঠাকুরপাড়া নীরদা সুন্দরী পাঠশালা, ঈশ্বর পাঠশালা, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ ও যথাক্রমে চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে।
৭১ এর মার্চের শেষের দিকে ছাত্র দেলোয়ার জাহিদ পালিয়ে যান কুমিল্লা থেকে ভৈরবে। তখন ভৈরব বাজার দখলে নেয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পাক হানাদার বাহিনী। নুরুর নেতৃত্বে দেলোয়ার জাহিদ ও আরো কয়জন তাদের প্রতিহত করতে বল্লম হাতে সেদিন ছুটে গিয়েছিলেন। দৌলতকান্দি হয়ে প্রচন্ড গোলাগুলির মধ্য দিয়ে যখন ভৈরব পৌঁছেন তখন বিমান থেকে মেশিনগান দিয়ে পাক সেনারা অবিরাম গুলি ছুঁড়ছিলো। এদিক সেদিক ছুটাছুটি করছে সবাই, পালাচ্ছে মানুষ, নারী, পুরুষ, শিশু সবাই নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে । পরিত্যক্ত দুটি রাইফেল নিয়ে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদীর কিনারে ছুটে এলেন নূরু আর দেলোয়ার। হাজার হাজার নারী পুরুষ নদী পারাপারের অপেক্ষায় । অস্বীকৃতি জানাচ্ছে মাঝি-মাল্লারা লোক পারাপারে। বিপন্ন মানুষ মৃত্যুর প্রহর গুনছে। যেকোন সময় যমদূত পাকি সেনারা এসে হাজির হবে। রাইফেল নিয়ে ত্বরিত গতিতে নুরু ও দেলোয়ার লাফিয়ে উঠলেন নৌকায়, পারাপার করলেন শত শত মানুষকে। এভাবেই নুরু ও দেলোয়ারের মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে যাওয়া।
দেলোয়ারের সহযোদ্ধা নুরুর বিভিন্ন দু:সাহসী অভিযানের খবর ছড়াতে শুরু হয় চারিদিকে। স্বাধীন বাংলা বেতার থেকেও বিভিন্ন অপারশনের কথা প্রচারিত হয়। নুরুর সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিলেন দেলোয়ার। আর নুরুকে নিয়োগ দান করেছিলেন তদানিন্তন মেজর (বর্তমানে অব: মেজর জেনারেল) মঈন এ চৌধুরী। নুরু তৎকালীন ভৈরব থানার ওসি কুতুবুর রহমান এবং কর্নেল (অব:) নুরুজ্জামানকেও ভারত পৌঁছে দেন। কুতুবুর রহমান ভৈরববাজারে ব্যাংক লুটের সমস্ত টাকা-পয়সা অসীম সাহসী নুরুকে নিয়েই স্বাধীন বাংলা সরকারের নিকট পৌঁছে দেন। ওসি কুতুবুর রহমানও ছিলেন একজন দু:সাহসী মুক্তিযোদ্ধা ও এক কিংবদন্তীর নায়ক। দেলোয়ার প্রশিক্ষণের জন্য চলে যান ভারতের নরসিংগর হয়ে কাঠালিয়া ক্যাম্পে মাসাধিককাল পর ফিরে আসেন মুক্তাঞ্চল নারায়ণপুরে। ৪ জুলাই, ১৯৭১ প্রকাশ্য দিবালোকে পাক বাহিনী পরিবেষ্টিত ভৈরব বাজারে দালাল শিরমনি মমতাজ পাগলার আড্ডায় তরকারি ওয়ালার ছদ্মবেশে অতর্কিতে আক্রমণ চালায় নুরু আতিক ও মোহন। হত্যা করে মমতাজ পাগলা ও তার দোসরদের। ভৈরবের মধ্যভাগে এ আক্রমণে পাকবাহিনী ভয়ে পালাতে থাকে। দুর্ভাগ্যক্রমে ঘটনাস্থলে শহীদ হন আতিক এবং মারাত্মক আহত অবস্থায় পাকবাহিনীর কাছে ধরা পড়েন নুরু, আর পালিয়ে আসে মোহন। দেলোয়ারের সহযোদ্ধা নুরুকে গুলি করে হত্যা করে পাক সেনারা। শহীদ নূরু দেলোয়ারের শুধু সহযোদ্ধাই ছিলেন না, ছিলেন প্রাণপ্রিয় মামা। শহীদ আতিক একজন মামাতো ভাই। দু’জন নিকটাত্মীয়কে হারিয়ে মুক্তিযোদ্ধা দেলোয়ার অনেকটা ভেঙ্গে পড়েন কিন্তু দায়িত্ব তাকে পিছু হটতে দেয়নি।
গেরিলাযুদ্ধের বিশিষ্ট সংগঠক নুরু-আতিকের শাহাদাত বরণের পর ৩ নং সাব সেক্টরের নারায়ণপুর মুক্তাঞ্চলে চরম এক নেতৃত্ব-শূন্যতার সৃষ্টি হয় । সেখানে তখন এফএফ এবং বিএলএফ এর যৌথ কমান্ড প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়। গঠিত হয় সর্বদলীয় যুদ্ধ পরিচালনা কমিটি। দেলোয়ার জাহিদকে ছাত্রফ্রন্টের সংগঠক নির্বাচিত করা হয়। তরুণ বয়সে ও এ দায়িত্বের বোঝা তাকে অর্পণ করা হয়। শহীদ নুরু আতিকের আশীর্বাদই ছিলো তার অনুপ্রেরণার উৎস। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা সার্জেন্ট (অবঃ) কাদের, নসা কাজী, ফকির সুরুজ মিয়া, আবদুল হান্নান, ছাত্রনেতা ওয়ালীউল্লা প্রমুখ এ পর্ষদে যোগ দেন। মুক্তিযোদ্ধা দেলোয়ারের জ্যাঠা মাওলানা ভাসানীর বিশিষ্ট সহচর ন্যাপ নেতা পন্ডিত আবদুস ছোবহান সহ আরো কয়েকজন ব্যক্তি ওই কমিটিতে অন্তর্ভূক্ত হন। কর্নেল (অব:) নুরুজ্জামানের শিক্ষক গয়েস আলী মাস্টার (এফএফ কমান্ডার) এর সাথে কাজ করেন এবং দৌলতকান্দি, নারায়ণপুর, বেলাব ও কালিকাপ্রসাদ সহ কয়েকটি যুদ্ধে অংশ নেন মুক্তিযোদ্ধা দেলোয়ার। রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের নিকটাত্মীয় বিএলএফ সংগঠক ও ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ভৈরবের ফয়সল আলমকে সংগে নিয়ে ৩ নং সেক্টরের আওতায় ৩ নং সাব-সেক্টরে এফএফ ও বিএলএফ এর কার্য্যক্রম সমন্বয় সাধন করে প্রভুত সফলতা লাভ করেন এবং সম্মান অর্জন করেন। এফএফ ও বিএলএফ সদস্যদের মধ্য সহযোগিতা ও সহমর্মিতার এক অনন্য নজির স্থাপন করেন মুক্তাঞ্চল নারায়ণপুরে।
সেদিনগুলো এখন শুধুই স্মৃতি। যুদ্ধোত্তোর সময়ে মনোনিবেশ করেন শিক্ষায়, চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বি.এ অনার্স (’৭৬) ও এম-এ (’৭৭) ডিগ্রি নিয়ে দু’বছর ল স্টাডি করেন কুমিল্লা ল কলেজে । কর্মজীবনে তিনি ছিলেন পরিচালক, বাংলাদেশ সমাজকল্যাণ একাডেমি। (৭৮-৮০), অধ্যক্ষ, নাঙ্গলকোর্ট কলেজ (৮০-৮২) প্রতিষ্ঠাতা সদস্য/ অধ্যাপক, কুমিল্লা মহিলা কলেজ (৮৩-৮৫) অধ্যক্ষ, কুমিল্লা আদর্শ কলেজ (৮৫-৮৮), সম্পাদক, বাংলা সাপ্তাহিক সমাজকন্ঠ (৮১-৮৮) যা স্বৈরাচারী সামরিক সরকার তৎসময়ে বন্দ্ধ করে দেয়। এর পুনঃ প্রকাশে হাইকোর্টে রিট আবেদন করতে হয় এবং সরকারের উপর হাইকোর্ট থেকে রুলনিশি ইস্যু হয়। তিনি ছিলেন প্রধান নির্বাহী বাংলাদেশ মানবাধিকার ফাউন্ডেশন (৮৯-৯৫), কুমিল্লা জেলা সভাপতি, বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা (৮২-৯২)। কুমিল্লা প্রেসক্লাব ও কুমিল্লা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি এবং জাতীয় সাংবাদিক সংস্থার কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সভাপতি। ভূমিহীন কৃষক ও প্রান্তিক চাষীদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য নিবেদিত স্থানীয় এনজিও সেবা মানবিক উন্নয়নকেন্দ্রের তিনি প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।
সংযুক্ত আরব আমিরাতে একটি জনসংযোগ চেম্বারের পরিচালক (৯২- ৯৪)। জার্মানিতে আইন সহায়তা পেশায় পিটার সিকের ল চেম্বার (৯৫-৯৭) ও প্রফেসার হাগার’স এর ল চেম্বার (৯৭-৯৯) এ একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা। ইউনিভার্সিটি অব এডুকেশান, ফ্রাইবুর্গ, জার্মানি এর রিসার্চ ফেলো (৯৬-৯৯), ইউনিভার্সিটি অব ভিগো, স্পেন এর রিসার্চ ফেলো (২০০০-২০০২) এবং স্প্যানিশ ডেইলি’র একজন নিয়মিত কলামিস্ট (২০০০-২০০২)। কানাডায়, কানাডিয়ান মেনোনাইট ইউনিভার্সিটি এর অ্যাসোসিয়েট রিসার্চ ফেলো (২০০৪) এবং সেন্ট পল্স কলেজ, ইউনিভার্সিটি অব ম্যানিটোবার রিসার্চ ফেলো ২০০৩ সাল থেকে বর্তমান। এছাড়াও কানাডার সাস্কাচুয়ান প্রদেশের মিনিস্ট্রি অব জাস্টিস এবং অ্যাটর্নি জেনারেল ২০১০ থেকে দেলোয়ার জাহিদকে ৫ বছরের জন্য নোটারি পাবলিক অব সাস্কাচুয়ান হিসাবে নিয়োগ দিয়েছেন । দীর্ঘ প্রবাস জীবনে জার্মান এবং স্পেনে মানবাধিকার ইস্যুতে গবেষণা, ও সাংবাদিকতায় প্রভূত অবদান রাখেন এবং বর্তমানে ইউরোপ থেকে কানাডায় এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন মুক্তিযোদ্ধা দেলোয়ার জাহিদ। রাজনীতি বিজ্ঞানে অধ্যাপণা, গবেষণা ও লেখালেখি ছাড়াও তিনি আইন এবং মানবাধিকার বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ নেন। বিশ্বের অন্যতম কনফ্লিক্ট রেজুলিওশানের প্রফেসর ডঃ ডিন ই পিচি’র একজন সহযোগী গবেষক হিসাবে তিনি সালিস -রুরাল ম্যাডিয়েশনের উপর গবেষণা করেন। তিনি জন হাওয়ার্ড সোসাইটি অব ম্যানিটোবা’র বোর্ড অব ডিরেক্টরসের মেম্বার এবং ম্যানিটোবা সেন্টার ফর স্যোশাল এন্ড পিস স্টাডিজ এর পরিচালক হিসাবে ও দায়িত্ব পালন করেন।
মুক্তিযুদ্ধ থেকে জীবনযুদ্ধে লড়াইয়ের পর লড়াই করে জীবনের এই প্রান্তে এসে আজ তিনি কিছুটা ক্লান্ত, শ্রান্ত ও অবসন্ন। দেশ ছেড়েছেন অনেক বছর কিন্তু শেকড় গেঁথে রয়েছে নিজ ভূমিতে, ভুলতে পারেননি প্রিয় শহর কুমিল্লার স্মৃতিময় দিনগুলি।আজও দেশের প্রতিটি ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে আবর্তিত হয় তাঁর সুখ-দুঃখ-হাসি-কান্না।তাইতো এই পড়ন্ত বেলাতেও তাঁর লেখনীতে ফুটে উঠে দেশের ভবিষ্যতের স্বপ্নজাল।
…….তাঁর দীর্ঘ জীবন ও সুস্হতা কামনায়-“আমাদের কুমিল্লা আমাদের গর্ব আমাদের অহংকার আমরা কুমিল্লার সন্তান”। (তথ্যসূত্র: বাংলা নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম)
লেখক পরিচিতি: নিগার সুলতানা নুপুর “আমাদের কুমিল্লা, আমাদের গর্ব-আমাদের অহংকার, আমরা কুমিল্লার সন্তান” এর একজন নিয়মিত ব্লগার.